Web application developer
- Chief Software Architecture at Konvex Technologies
- Lives in Bogra
- From Bogra
- Male
- Followed by 6 people
Basic Info
- Disctrict
Bogra
Recent Updates
- বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা উৎপত্তি ও বিকাশঃ
১. মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা। ভাষার কথ্য, লেখ্য ও প্রতীকী রূপ আছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার ভাষা এখন সারাবিশ্বের মানুষের মুখে মজুদ। বিলুপ্ত হয়েছেও ঢের। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস এবং ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস প্রায় সমসাময়িক। মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষা। দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা থাকে। বদলে কালের আবর্তনে কিংবা অন্য ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনে। মিথস্ক্রিয়াও হয়। কালচারাল রিলেটিভিজম বলে সেটিকে। এর ফলে কৃৃৃতঋণ শব্দে ভাষা ঋদ্ধ হয়। একটি ভাষার থাকে অনেকগুলো উপভাষা। উপভাষার কোনোটি আবার বহুল ব্যবহারের ফলে কেন্দ্রীয় উপভাষার স্থান দখল করে। উপভাষার বিবর্তন হয় ধীর লয়ে, প্রমিত ভাষার পরিবর্তন দ্রুত ও দৃশ্যমান। উপভাষার আবার অঞ্চলভেদে অনেক রকমভেদ থাকে যা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে খ্যাত। আঞ্চলিক ভাষা হলো সংশ্লিষ্ট ভাষার শেকড়, মাটির ঘ্রাণ, মায়ের টান।
২. বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রধানভাষা বাংলা। ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে বিশ্বে সপ্তম। প্রায় ৫০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। আজকের বাংলাভাষায় যেমন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য বিরাজ করছে, তেমনি উৎপত্তির শুরু থেকে নানা বিবর্তনে বর্তমান রূপে এসে ঠেকেছে। ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে বাংলার আবির্ভাব যার পেছনের মূল ভাষাবংশ ইন্দো-ইউরোপীয় এবং উৎপত্তির সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের আগেই। বাংলাভাষায় দ্রাবিড়, অস্ট্রিক প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি নানা ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ায় অনেক কৃতঋণ শব্দ বঙ্গভান্ডারে বিবিধ রতন হিসেবে যোগ হয়েছে। যেমন- সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি, হিন্দি, তুর্কি, ভোটবর্মী, পর্তুগিজ, ইংরেজি ইত্যাদি। বাংলাভাষার যেমন হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, তেমনি রয়েছে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মতো গৌরবজনক অধ্যায়।
৩. উত্তরবঙ্গের রাজধানী বা প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত বগুড়া জেলার আধুনিক ইতিহাসের সূত্রপাত দুশো বছরের হলেও বগুড়া তথা প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমগ্র বাংলার ইতিহাস সমান্তরাল। একে অন্যের পরিপূরক। মুদ্রার এপিঠওপিঠ। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে মৌর্যবংশ রাজ্যের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে পরবর্তী গুপ্ত, পাল, সেন যুগ, সুলতানি আমল থেকে আধুনিক যুগপর্যন্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ বগুড়া। পাল রাজা ও তাদের পূর্বসূরিরা বৌদ্ধধর্ম চর্চা করায় বাংলাবান্ধব ছিলেন। ছিলেন সংস্কৃত বিরোধী। বৃহত্তর বগুড়ার সোমপুর বিহার (বর্তমানে নওগাঁ) ও মহাস্থান বিহার থেকে পরিচালিত হত বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষা, বাংলা পঠন-পাঠন। সেন যুগে পাশা উলটে গেলে বাংলা আবার অচ্ছুৎ হয়ে যায়। মুক্তি মেলে বখতিয়ার খিলজির হাতে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার সূত্রপাত মূলত সে সময়েই। বগুড়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি তাই অনন্য মাত্রার অধিকারী। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের বীরত্বগাথা সর্বজনবিদিত।
৪. গুপ্ত রাজবংশের পতন ও পালদের উত্থানের মাঝামাঝি অর্থাৎ ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পূর্বভারতীয় এই জনপদটি যখন রাঢ়, গৌড় বা বরেন্দ্র, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল বিভিন্ন ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত, সংকুচিত ও সীমিত হয়ে যায় তখনই বাংলাভাষার উপভাষাগুলোর উদ্ভব হয়। রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খন্ডী, রাজবংশী-কামরূপী, বঙ্গাল প্রভৃতি উপভাষা সেই স্মৃতিই আজও বহন করে চলেছে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা মূলত বরেন্দ্রী উপভাষার প্রতিনিধিত্ব করলেও রাজবংশী-কামরূপী উপভাষার উপাদানের সংমিশ্রণ এখানে উল্লেখযোগ্য। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আবার বিশুদ্ধ রাঢ়ী উপভাষার ব্যবহারও বিদ্যমান। বর্তমান বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় পাঁচ প্রকারের- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ও সদর। দক্ষিণ, পশ্চিম ও সদরে বরেন্দ্রীর প্রভাব বেশি। উত্তর-পূর্ব তথা শিবগঞ্জ, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনটের কিছু অংশ বিশেষ করে যমুনার চর এলাকাতে কিছুটা রাজবংশী-কামরূপী উপভাষার চল দেখা যায়। রাজবংশীকে রংপুরী উপভাষা বলাই শ্রেয়। পূর্ব-পশ্চিমের গ্রামাঞ্চলে কথাবার্তায় এক/দুই মাত্রা টান দেখা যায়। এর কারণ মূলত নদীমাতৃক ও কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি। যে অঞ্চলের অধিবাসী অখন্ড অবসর বেশি পায় তাদের ভাষায় তত টান পাওয়া যায়।
৫. ‘আলু আলু অক ক্যা লিয়্যা আলু’, ‘জিউ যেটি যিনক্যা’, ‘পুঁটি মাছ ধরবার যাইয়্যা ধরে আনি বোল, হামরা বোগড়্যার ছোল’ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু উক্তি দেশে-বিদেশে বগুড়ার ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’এ বগুড়ার ভাষার উদাহরণ দেয়া আছে- ‘এ্যাক ঝনের দুই ব্যাট্যা ছৈল আছিল। তারকেরে মদধ্যে ছোট জন কৈল, “বা, হামি যা পামু তা হামাক ব্যাঁট্যা দে”। তাই শুনে বাপে ব্যাঁট্যা দিল। এটি বর্তমান শাহজাহানপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কথ্যভাষা হিসেবে চালু।
ধ্বনিতত্ত¡ অনুযায়ী বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় মহাপ্রাণ ঘোষবর্ণ, চ বর্গ, ড়, ঢ় ও আদি হ বর্ণের উচ্চারণ সংরক্ষিত কিন্তু স, শ, ষ সবক্ষেত্রে ‘শ’ উচ্চারণ লক্ষণীয়। তবে মধ্যে ও অন্তে প্রায়ই মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণে রূপ নেয়। যেমন- বাগ>বাঘ, দুদ>দুধ ইত্যাদি। ‘এ’ ধ্বনি ‘অ্যা’ এর মতো হয়। যেমন- অ্যাকলা অ্যালা (একলা এলে)। আদি স্বরে ‘র’ লোপ, যেমন- অসুন (রসুন), অস (রস), অক্ত (রক্ত) ইত্যাদি। আবার আদিতে ‘র’ স্বরাগম, যেমন- রিদ (ঈদ), রজু (অজু) ইত্যাদি। ‘ন’ এর স্থলে ‘ল’ অথবা ‘ল’ এর স্থানে ‘ন’ ব্যবহার নৈমিত্তিক। যেমন- লালা (নালা), লদী (নদী), নোয়া (লোহা) ইত্যাদি। রাজবংশী বা রংপুরী উপভাষাকে অনুসরণ করে ‘জ’ ও ‘য’ এর উচ্চারণ ইংরেজি ত এর মতো। যেমন- বাজান, আজান, রমজান, হাজার ইত্যাদি।
রূপতত্তে¡ উল্লেখযোগ্য হলো- উত্তম পুরুষে সর্বনামে ‘হাম’ ব্যবহৃত হওয়া। গৌণকর্মে ‘কে’ এর পরিবর্তে ‘ক’ বিভক্তির চল বেশি। যেমন- ‘হামাক ভাত দেও’। সপ্তমী ও অধিকরণ কারকে ‘ত’ বা ‘ৎ’ প্রচলিত। যেমন- ‘ঘরৎ যাও’। ‘হাড়িত ভাত নাই’। ক্রিয়ার শেষে ‘নু’ এবং অতীতকালে ‘লাম’ প্রত্যয় যোগ হয়। যেমন- গেনু, খানু, করনু, গেলাম, খ্যালাম, কল্লাম ইত্যাদি। অন্তিম ব্যঞ্জনে দ্বিত হয়। চলমান বর্তমানে ‘ছি’ বা ‘তেছি’ প্রতিস্থাপিত হয়ে ‘চ’ এর দ্বিত পরিলক্ষিত হয়। যেমন- গেচ্চি, খাচ্চি, করিচ্চি ইত্যাদি। ভবিষ্যতকালে সাধারণ কিংবা নিশ্চিত অর্থে ক্রিয়ার পরে ‘নি’ প্রত্যয় যোগ হয়। যেমন- যামুনি, খামুনি, আসমুনি ইত্যাদি। এছাড়া কিছু ইউনিক শব্দ ও উচ্চারণ বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য। যেমন- ক্যাংকা (কেমন), ইংক্যা (এমন), যিংক্যা (যেমন), সিংক্যা (তেমন) ইত্যাদি। নন্দনতত্তে¡ এই অঞ্চলের ভাষা সমৃদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, উপমা ও মেঠেল শব্দের অভয়ারণ্য এই জনপদ। দাদা-দাদির মুখে প্রায়ই শোনা যায় এসব শাস্ত্রীয় উপাদান। যেমন- কাকরুই (চিরুনি), চিলুমচি (হাত ধোয়ার পাত্রবিশেষ), ড্যাশ্যা (মোটা অর্থে), সাফসকিনা (পরিষ্কার করা), ভাতার (স্বামী) ইত্যাদি। এ ভাষার নিজস্ব গালিবুলিও নেহায়েত কম নয়।
৬. শিক্ষানগরী খ্যাত বগুড়া শহরে শিল্প-বাণিজ্য দ্রæত প্রসার লাভ করেছে। তরলীকৃত গ্যাসের সহজলভ্যতার কারণে মাঝারি থেকে ভারী শিল্পের বিকাশ সহজতর হওয়ায় জীবনমান উন্নয়ন হয়েছে। বগুড়া শহরে তাই আশেপাশের জেলা-উপজেলার মানুষের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে আদি বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিতেও প্রভাব পড়ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে বগুড়ার ভাষা মিশ্র হয়ে ধরা দিচ্ছে। তাছাড়া নব্বইয়ের দশকে বগুড়া শহরাঞ্চলে যে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব হয়েছিল তারাও পারিবারিকভাবে তাদের সন্তানদের আঞ্চলিক ভাষা উদ্বুদ্ধ করেন না। এর কারণ হীনম্মন্যতা, জাতে ওঠার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৈ কিছু নয়। তাই সিলেট, চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীর মতো আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধ বগুড়ায় গড়ে ওঠেনি। কমে গেছে লিখিয়েদের মধ্যে লেখ্যভাষার চর্চাও। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক কথন, পঠন, লিখনের মাধ্যমে এই অচলাবস্থা অদূর ভবিষ্যতে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেই প্রত্যাশা নিরন্তর।
তথ্য সূত্রঃ https://cutt.ly/OX0TtxGবগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা উৎপত্তি ও বিকাশঃ ১. মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই হলো ভাষা। ভাষার কথ্য, লেখ্য ও প্রতীকী রূপ আছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার ভাষা এখন সারাবিশ্বের মানুষের মুখে মজুদ। বিলুপ্ত হয়েছেও ঢের। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস এবং ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস প্রায় সমসাময়িক। মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষা। দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতা থাকে। বদলে কালের আবর্তনে কিংবা অন্য ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসনে। মিথস্ক্রিয়াও হয়। কালচারাল রিলেটিভিজম বলে সেটিকে। এর ফলে কৃৃৃতঋণ শব্দে ভাষা ঋদ্ধ হয়। একটি ভাষার থাকে অনেকগুলো উপভাষা। উপভাষার কোনোটি আবার বহুল ব্যবহারের ফলে কেন্দ্রীয় উপভাষার স্থান দখল করে। উপভাষার বিবর্তন হয় ধীর লয়ে, প্রমিত ভাষার পরিবর্তন দ্রুত ও দৃশ্যমান। উপভাষার আবার অঞ্চলভেদে অনেক রকমভেদ থাকে যা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে খ্যাত। আঞ্চলিক ভাষা হলো সংশ্লিষ্ট ভাষার শেকড়, মাটির ঘ্রাণ, মায়ের টান। ২. বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রধানভাষা বাংলা। ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে বিশ্বে সপ্তম। প্রায় ৫০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। আজকের বাংলাভাষায় যেমন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য বিরাজ করছে, তেমনি উৎপত্তির শুরু থেকে নানা বিবর্তনে বর্তমান রূপে এসে ঠেকেছে। ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে বাংলার আবির্ভাব যার পেছনের মূল ভাষাবংশ ইন্দো-ইউরোপীয় এবং উৎপত্তির সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের আগেই। বাংলাভাষায় দ্রাবিড়, অস্ট্রিক প্রভাব যেমন রয়েছে, তেমনি নানা ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ায় অনেক কৃতঋণ শব্দ বঙ্গভান্ডারে বিবিধ রতন হিসেবে যোগ হয়েছে। যেমন- সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি, হিন্দি, তুর্কি, ভোটবর্মী, পর্তুগিজ, ইংরেজি ইত্যাদি। বাংলাভাষার যেমন হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস, তেমনি রয়েছে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মতো গৌরবজনক অধ্যায়। ৩. উত্তরবঙ্গের রাজধানী বা প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত বগুড়া জেলার আধুনিক ইতিহাসের সূত্রপাত দুশো বছরের হলেও বগুড়া তথা প্রাচীন পুন্ড্রনগরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমগ্র বাংলার ইতিহাস সমান্তরাল। একে অন্যের পরিপূরক। মুদ্রার এপিঠওপিঠ। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে মৌর্যবংশ রাজ্যের গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে পরবর্তী গুপ্ত, পাল, সেন যুগ, সুলতানি আমল থেকে আধুনিক যুগপর্যন্ত একটি সমৃদ্ধ জনপদ বগুড়া। পাল রাজা ও তাদের পূর্বসূরিরা বৌদ্ধধর্ম চর্চা করায় বাংলাবান্ধব ছিলেন। ছিলেন সংস্কৃত বিরোধী। বৃহত্তর বগুড়ার সোমপুর বিহার (বর্তমানে নওগাঁ) ও মহাস্থান বিহার থেকে পরিচালিত হত বৌদ্ধধর্মীয় শিক্ষা, বাংলা পঠন-পাঠন। সেন যুগে পাশা উলটে গেলে বাংলা আবার অচ্ছুৎ হয়ে যায়। মুক্তি মেলে বখতিয়ার খিলজির হাতে। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার সূত্রপাত মূলত সে সময়েই। বগুড়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতি তাই অনন্য মাত্রার অধিকারী। ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলের বীরত্বগাথা সর্বজনবিদিত। ৪. গুপ্ত রাজবংশের পতন ও পালদের উত্থানের মাঝামাঝি অর্থাৎ ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পূর্বভারতীয় এই জনপদটি যখন রাঢ়, গৌড় বা বরেন্দ্র, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল বিভিন্ন ছোট ছোট জনপদে বিভক্ত, সংকুচিত ও সীমিত হয়ে যায় তখনই বাংলাভাষার উপভাষাগুলোর উদ্ভব হয়। রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খন্ডী, রাজবংশী-কামরূপী, বঙ্গাল প্রভৃতি উপভাষা সেই স্মৃতিই আজও বহন করে চলেছে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা মূলত বরেন্দ্রী উপভাষার প্রতিনিধিত্ব করলেও রাজবংশী-কামরূপী উপভাষার উপাদানের সংমিশ্রণ এখানে উল্লেখযোগ্য। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে আবার বিশুদ্ধ রাঢ়ী উপভাষার ব্যবহারও বিদ্যমান। বর্তমান বগুড়া জেলার আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় পাঁচ প্রকারের- পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ও সদর। দক্ষিণ, পশ্চিম ও সদরে বরেন্দ্রীর প্রভাব বেশি। উত্তর-পূর্ব তথা শিবগঞ্জ, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনটের কিছু অংশ বিশেষ করে যমুনার চর এলাকাতে কিছুটা রাজবংশী-কামরূপী উপভাষার চল দেখা যায়। রাজবংশীকে রংপুরী উপভাষা বলাই শ্রেয়। পূর্ব-পশ্চিমের গ্রামাঞ্চলে কথাবার্তায় এক/দুই মাত্রা টান দেখা যায়। এর কারণ মূলত নদীমাতৃক ও কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি। যে অঞ্চলের অধিবাসী অখন্ড অবসর বেশি পায় তাদের ভাষায় তত টান পাওয়া যায়। ৫. ‘আলু আলু অক ক্যা লিয়্যা আলু’, ‘জিউ যেটি যিনক্যা’, ‘পুঁটি মাছ ধরবার যাইয়্যা ধরে আনি বোল, হামরা বোগড়্যার ছোল’ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু উক্তি দেশে-বিদেশে বগুড়ার ট্রেডমার্ক হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’এ বগুড়ার ভাষার উদাহরণ দেয়া আছে- ‘এ্যাক ঝনের দুই ব্যাট্যা ছৈল আছিল। তারকেরে মদধ্যে ছোট জন কৈল, “বা, হামি যা পামু তা হামাক ব্যাঁট্যা দে”। তাই শুনে বাপে ব্যাঁট্যা দিল। এটি বর্তমান শাহজাহানপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কথ্যভাষা হিসেবে চালু। ধ্বনিতত্ত¡ অনুযায়ী বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় মহাপ্রাণ ঘোষবর্ণ, চ বর্গ, ড়, ঢ় ও আদি হ বর্ণের উচ্চারণ সংরক্ষিত কিন্তু স, শ, ষ সবক্ষেত্রে ‘শ’ উচ্চারণ লক্ষণীয়। তবে মধ্যে ও অন্তে প্রায়ই মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণে রূপ নেয়। যেমন- বাগ>বাঘ, দুদ>দুধ ইত্যাদি। ‘এ’ ধ্বনি ‘অ্যা’ এর মতো হয়। যেমন- অ্যাকলা অ্যালা (একলা এলে)। আদি স্বরে ‘র’ লোপ, যেমন- অসুন (রসুন), অস (রস), অক্ত (রক্ত) ইত্যাদি। আবার আদিতে ‘র’ স্বরাগম, যেমন- রিদ (ঈদ), রজু (অজু) ইত্যাদি। ‘ন’ এর স্থলে ‘ল’ অথবা ‘ল’ এর স্থানে ‘ন’ ব্যবহার নৈমিত্তিক। যেমন- লালা (নালা), লদী (নদী), নোয়া (লোহা) ইত্যাদি। রাজবংশী বা রংপুরী উপভাষাকে অনুসরণ করে ‘জ’ ও ‘য’ এর উচ্চারণ ইংরেজি ত এর মতো। যেমন- বাজান, আজান, রমজান, হাজার ইত্যাদি। রূপতত্তে¡ উল্লেখযোগ্য হলো- উত্তম পুরুষে সর্বনামে ‘হাম’ ব্যবহৃত হওয়া। গৌণকর্মে ‘কে’ এর পরিবর্তে ‘ক’ বিভক্তির চল বেশি। যেমন- ‘হামাক ভাত দেও’। সপ্তমী ও অধিকরণ কারকে ‘ত’ বা ‘ৎ’ প্রচলিত। যেমন- ‘ঘরৎ যাও’। ‘হাড়িত ভাত নাই’। ক্রিয়ার শেষে ‘নু’ এবং অতীতকালে ‘লাম’ প্রত্যয় যোগ হয়। যেমন- গেনু, খানু, করনু, গেলাম, খ্যালাম, কল্লাম ইত্যাদি। অন্তিম ব্যঞ্জনে দ্বিত হয়। চলমান বর্তমানে ‘ছি’ বা ‘তেছি’ প্রতিস্থাপিত হয়ে ‘চ’ এর দ্বিত পরিলক্ষিত হয়। যেমন- গেচ্চি, খাচ্চি, করিচ্চি ইত্যাদি। ভবিষ্যতকালে সাধারণ কিংবা নিশ্চিত অর্থে ক্রিয়ার পরে ‘নি’ প্রত্যয় যোগ হয়। যেমন- যামুনি, খামুনি, আসমুনি ইত্যাদি। এছাড়া কিছু ইউনিক শব্দ ও উচ্চারণ বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য। যেমন- ক্যাংকা (কেমন), ইংক্যা (এমন), যিংক্যা (যেমন), সিংক্যা (তেমন) ইত্যাদি। নন্দনতত্তে¡ এই অঞ্চলের ভাষা সমৃদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবাদ-প্রবচন, বাগধারা, উপমা ও মেঠেল শব্দের অভয়ারণ্য এই জনপদ। দাদা-দাদির মুখে প্রায়ই শোনা যায় এসব শাস্ত্রীয় উপাদান। যেমন- কাকরুই (চিরুনি), চিলুমচি (হাত ধোয়ার পাত্রবিশেষ), ড্যাশ্যা (মোটা অর্থে), সাফসকিনা (পরিষ্কার করা), ভাতার (স্বামী) ইত্যাদি। এ ভাষার নিজস্ব গালিবুলিও নেহায়েত কম নয়। ৬. শিক্ষানগরী খ্যাত বগুড়া শহরে শিল্প-বাণিজ্য দ্রæত প্রসার লাভ করেছে। তরলীকৃত গ্যাসের সহজলভ্যতার কারণে মাঝারি থেকে ভারী শিল্পের বিকাশ সহজতর হওয়ায় জীবনমান উন্নয়ন হয়েছে। বগুড়া শহরে তাই আশেপাশের জেলা-উপজেলার মানুষের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ফলে আদি বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতিতেও প্রভাব পড়ছে। নতুন প্রজন্মের কাছে বগুড়ার ভাষা মিশ্র হয়ে ধরা দিচ্ছে। তাছাড়া নব্বইয়ের দশকে বগুড়া শহরাঞ্চলে যে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব হয়েছিল তারাও পারিবারিকভাবে তাদের সন্তানদের আঞ্চলিক ভাষা উদ্বুদ্ধ করেন না। এর কারণ হীনম্মন্যতা, জাতে ওঠার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বৈ কিছু নয়। তাই সিলেট, চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীর মতো আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধ বগুড়ায় গড়ে ওঠেনি। কমে গেছে লিখিয়েদের মধ্যে লেখ্যভাষার চর্চাও। বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক কথন, পঠন, লিখনের মাধ্যমে এই অচলাবস্থা অদূর ভবিষ্যতে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে সেই প্রত্যাশা নিরন্তর। তথ্য সূত্রঃ https://cutt.ly/OX0TtxG - আলহামদুলিল্লাহ দেখতে দেখতে www.cyberbogra.com ১৫ বছরের পদার্পন করল। সেই ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে বর্তমানে আমাদের ওয়েব সাইট অনেকটা ফেসবুকের আদলে দারকরানো হয়েছে। এ বছর আরও কাজ করা হবে ইনশাআল্লাহ। সবায়কে নতুন ইংরেজী বছরের শুভেচ্ছা।আলহামদুলিল্লাহ দেখতে দেখতে www.cyberbogra.com ১৫ বছরের পদার্পন করল। সেই ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে বর্তমানে আমাদের ওয়েব সাইট অনেকটা ফেসবুকের আদলে দারকরানো হয়েছে। এ বছর আরও কাজ করা হবে ইনশাআল্লাহ। সবায়কে নতুন ইংরেজী বছরের শুভেচ্ছা। :heart:
More Stories